সামনে বিশাল জলরাশি । যে দিকে তাকাই জল, শুধুই জল । মাঝে মধ্যে একটা দুটো হিজল গাছ গলা জলে দাঁড়িয়ে । আমরা দাঁড়িয়ে আছি শনবিলের কালিবাড়ি বাজারের ঘাটে । একসময়ে আমার ধারণা ছিল এই সেই কালিবাড়ি ঘাট যেখানে একসময়ে কচুয়া নদীর বুক বেয়ে ডজন ডজন, বিশেষ করে ভরা শ্রাবণে প্রতি বৃহস্পতি, শুক্রবার কম করেও কুড়ি থেকে পঞ্চাশটি খেন্না আসতো, আর আসতো নৌকা দৌড়ের নৌকা । খেন্না হচ্ছে একপ্রকার উঁচু গলইযুক্ত লম্বা নৌকা । আর সেই সাথে হতো সারিগান গেয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ শনবিল নৌকা দৌড় প্রতিযোগিতা । এই দুটো দিন ঘাটে যেন উৎসবের মেজাজ ছিল। সারা রাত জুড়ে মেলা বসতো । পদ্মপুরাণ পাঠ, বাউল গান, মনসা মঙ্গল নাটক, পুতুল নাচ সাথে আরও কত কি । ১৯৫১ সনে কচুয়া নদীতে সুইস গেইট বসে যাওয়ার পর সব শেষ। আমার ধারণা ছিল আমরা সেই ঘাট থেকেই নৌকা বিহারে যাবো । এসে বোঝা গেল এই ঘাট সেই আনন্দপুর কালিবাড়ি ঘাট নয় । আসলে প্রায় কুড়ি বছর পর আমার শনবিলে আসা । পুরো শনবিলটাই অনেকখানি পাল্টে গেছে । রাস্তাঘাটে পিচের আঁচর না পড়লেও ব্লক বসানো হয়েছে অনেক জায়গাতেই। দোকান পাট আজকাল তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি ।
ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি, যতদূর চোখ যায় জল শুধু জল । মেশিন চালানো নৌকাগুলো যাত্রী নিয়ে অনেকটা দূরে । হাত চালানো নৌকা আছে ঘাটে, কিন্ত আকাশের ভাব নাকি ভাল নয় তাই কেউ সাওয়ারী নিতে নারাজ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। একে তো এই সেই ঘাট নয় তার উপর নৌকা বিহার বাতিল। পুরো বিকেলটাই বরবাদ হয়ে গেল ।
বিশ্বজ্যোতি যেন মনের ভাব আঁচ করেই আশ্বস্ত করে বললে, দাদা মন খারাপ করবেন না । যদি কপাল সাথ দেয় তবে এমন জিনিস দেখতে পাবেন, স্বপ্নেও যা কোনদিন ভাবতে পারেন নি ।
বিশ্বজ্যোতি স্থানীয় ছেলে, আমার গাইডও বটে । কোথাও থেকে দুটো চেয়ার এনে ঘাটেই বাঁধানো চাতালে পেতে বসতে দিয়ে বলল, চা খাবেন তো ?
বললাম, শুধুই চা, আর কিছুই নয় ।
শনবিল আসলেই এক বিরাট খাজনা । এখানে ইতিহাস থেকে সংস্কৃতি, শিল্পী, সাহিত্যিক- সবার মনের খোরাক যোগায় একা শনবিল। এখানকার মাছ, এখানকার গাছ, চোখের সামনে সুবিশাল প্রাকৃতিক পট । ঘাটে ঘাটে গল্প আর উপগল্পের ঢিপি । শনবিল তাই আমাকে খুব আকর্ষণ করে । কিন্ত একটা বিশেষ কারণে আসা হয়ে ওঠে না, নইলে আমি হয়তো এখানেই পাকাপোক্ত আস্তানা গাড়তাম ।
বিশ্বজ্যোতি আমাকে ঘাটে বসিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেছে । আমি একা বসে আছি ঘাটে । হাতের ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি ।ইচ্ছে ছিল কিছু ভাল ছবি তোলার। এখন মনে হচ্ছে সেই আশার গুড়ে বালি ।
বিশাল বাঁধানো চালাল । মাথার উপর একটা শেড আছে । আমি একা বসে আছি নির্জনে নিশ্চুপ। এতক্ষণ একটা হালকা বাতাস চলছিল, মন্দ মধুর হাওয়া । হঠাৎই মনে হলো রৌদ্রের তেজ যেন কমে যাচ্ছে । আকাশ ফুঁড়ে কোথা থেকে বিশাল বিশাল মেঘ এসে আকাশ ঢেকে যাচ্ছে । শনবিলের বুকে কালো কালো ছায়া । বাতাসের গতি ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর
হচ্ছে। হঠাৎই পুরো বিল জুড়ে ভীষণ ব্যস্ততা । পাড়ে বাঁধা নৌকাগুলো আবারও শক্ত করে বাঁধছে মাঝিরা । ঢেউগুলো সাপের ফেনা যেন, ফোঁসছে । যারা এতক্ষণ মাঝ দরিয়ায় ছিল এবার তাদেরও ফেরার পালা শুরু । কে একজন পাড় থেকে ক্রম আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছে, মাঝি ভাই, সাবধান হো---, ঝড় আইসতেছে । আওয়াজটা ক্রমশ প্রতিধ্বনি তুলে এক নৌকা আরেক নৌকায় ছুটতে লাগলো । আর পাশাপাশি ছুটতে লাগল ভয়, ক্রমে ক্রমে সমস্ত শনবিলটাই গিলে খাবে সে । যাত্রীদের মুখ শুকিয়ে কালো । যারা ছই-এ বসে সেলফি নিচ্ছিলেন, তারা ছাউনিতে গুটিসুটি বসা । বাতাসে সোঁ সোঁ শব্দ, ঢেউগুলো যেন মানুষ সমান উঁচু । হাল ধরে রাখা শক্ত। প্রতি মূহুর্তে শঙ্কা, এই বুঝি নৌকা পাল্টি খেল জলে । অনেকেই সাঁতার জানেন না । নৌকায় নৌকায় কান্না আর একশ কোটি দেবতাদের একসঙ্গে আহ্বান চলছে কায় মন বাক্যে । মাঝির চোয়ালে কঠিন পরীক্ষার প্রস্তুতি । মনে মনে ডাকছে, দোহাই বাবা বদর পীর, আমার নাওএ এসো । শক্ত করে হাল ধর, রক্ষা কর বাবা রক্ষা কর । আবার নিজেই যাত্রীদের সাহস দিয়ে বলছে, "একদম ভয় পাইবেন না । কিন্ত সাবধান, বেশি ছটফটানি করলেই বিপদ । ছইয়ে ধইরে থাকেন শক্ত করে । ঝড় আসতেছে, ভয় পাওনের কিছু নাই। আমি তো আছি , শেষ দেইখ্যা ছাড়মু ।" কিন্ত কে কার কথা শুনে, শান্ত শনবিল এখন তারকা রাক্ষসী।
যে জলের রঙ এতক্ষণ সাদামাটা ছিল এখন আকাশী হয়ে গাঢ় নীল। আকাশ যেখানে বিল ছুঁয়েছে, খানিকটা তার উপরে হঠাৎই মেঘ ফুঁড়ে সোনালী সূর্য। আর তার পাশ ঘিরে হলুদ থেকে লাল হতে হতে সমস্ত আকাশটা গাঢ় নীল । নীচে ঘন কালো জলে একটা বিশাল জায়গা জুড়ে সোনালী চাদর পাতা ।ঢেউ এর গায়ে ঢেউ লেগে চিকচিক করছে যেন খাঁজ কাটা গয়না। আমি তখন স্থবির, ভয়ে, বিশ্ময়ে দিশেহারা।
বিশ্বজ্যোতি ছুটে এসে বললেন, দাদা দেখছেন কী ? ক্যামেরা খুলুন । এমন দৃশ্য কপাল থাকলেই দেখা যায় । আমি তখন সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছি । ক্যামেরাটা পাশের চেয়ারের উপর রাখা। ইচ্ছে করছিল না । কিছু মুহুর্ত থাকে যখন ল্যান্সে চোখ না রেখে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে বেশি । আকাশে ততক্ষণে রঙের খেলা শুরু । মূহুর্তে মূহুর্তে আকাশের রঙ যাচ্ছে পাল্টে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে জলের রঙ । যারা এতক্ষণে পাড়ে ফিরে এসেছে তাদের প্রত্যেকের ক্যামেরা আর মোবাইলে ছবিবন্দিতে ব্যস্ত। আমি শুধু স্থির, স্থবির ।একমনে দেখছি রুদ্রানী শনবিলের অপরূপ সুন্দরী রূপ ।
কি করে যে একটি ঘন্টা কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি । একসময় সন্ধ্যা নামলো বিলে ।বাতাসের সেই সোঁ সোঁ শব্দের দাপট এখন স্তিমিত। শান্ত হয়েছে ঢেউ। আবারও জাল নিয়ে নৌকা ভাসলো জলে সারা রাতের জন্য।
বিশ্বজ্যোতিই প্রথম নীরবতা ভেঙ্গে বললে, কেমন দেখলেন দাদা ?
বললাম, যদি বলি অপূর্ব, তাহলেও অপূর্ণ থেকে যাবে অনেক কিছুই। শুধু এটুকু বলতে পারি, এই ছোট্ট জীবনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে সূর্যাস্ত দেখেছি, কিন্ত আজকের এই অভিজ্ঞতা সত্যি অতুলনীয়।
শনবিলে আমার এই প্রথম আসা নয় । তাই কিছুটা হলেও তার ভৌগলিক অবস্থান আমার জানা । পশ্চিমে ধোয়ালিয়া, পুবে সিরিসপুরের পাহাড় ।মধ্যে দৈর্ঘ্যে ১৮ কিঃ মিটার, প্রস্তে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল । লুসাই পাহাড় থেকে সিংলা নদী শনবিলের বুক চিড়ে কচুয়া নাম নিয়ে কুশিয়ারাতে গিয়ে মিশেছে। ভরা বর্ষায় তার আয়তন ১০০ বর্গ কিলোমিটারের অধিক । আবার শীত এলে সব শুকিয়ে শেষ ।তখন মরা নদীর দশা । জায়গায় জায়গায় উঁচু টিলা, আর চারপাশে খালের মত জলাশয় । তখন সেখানে স্থানে স্থানে শুকনো জায়গা জুড়ে ধানের চাষ আর টিলায় টিলায় হাঁস গরুর ঢেড়া । আমি শীতেই এসেছি বার কয়েক। দেখেছি খাগের গায়ে জমাট বাঁধা শুকিয়ে যাওয়া মাছের ডিম ।বর্ষা যখন জলে তোড়ে ভাসিয়ে দেয় খাগের আগা, সেই ডিম ফুটে জন্ম নেয় অগণিত মাছ ।
আমার শনবিলে আসা প্রথম বার চৌদ্দ মাদলের টানে । সে এক অদ্ভুত মেলা । নাম শুনলে মনে হতে পারে চৌদ্দ মৃদঙ্গের নাম কীর্তন, আসলে তা নয় । শীতের শনবিল যখন সবুজ ঘাসে ভরা, ধুধু মাঠ - স্থানে স্থানে উঁচু টিলা আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে জলাভূমি । ধান কাটা শেষ , হাতে অফুরন্ত সময় - সদ্য সদ্য ভিটে ছাড়া উদ্বাস্তুদের মনে তখন দেশভাগের দগদগে ঘা শুকিয়ে দেশবাড়ির সুখ স্মৃতি সবে উঁকি দিতে শুরু হয়েছে ।একটানা কুড়ি বছরের সংগ্রামের শেষে এখন তারা অনেকটাই স্থিতিশীল। তাই যখন প্রস্তাব এলো একটা কিছু করার, সবার সহমতে স্থির হলো হরিনাম সংকীর্তন হবে সাথে হবে মেলা । সেই শুরু ১৯৬৭ সালে আনন্দপুরের মাঠে, আজও বহাল পূর্ণকলেরবে। নামটা চৌদ্দ মাদল রাখার পেছনেও সেই পূর্ব বাংলার সুখস্মৃতি । ওখানকার তিপ্পারা জেলার বাঙালপাড়াতে কিছু বিত্তশালী ব্যক্তিরা প্রতি বছর মাঘ মাসের চার তারিখ চৌদ্দ মাদল নাম দিয়ে আয়োজন করতেন হরিনাম সংকীর্তন, সাথে হতো মেলা । এখানে শুধু একদিনের পরিবর্তে দুদিন আর তারিখ পাল্টে ঠিক হল ১৩ আর ১৪ মাঘ । সেই থেকেই চৌদ্দ মাদল উৎসব চলছে । এখন কীর্তন হয় দুদিন, তবে মেলা চলে সাতদিন। বাকি দিনগুলোতে যাত্রা পালা, পুতুল নাচ ইত্যাদি । শনবিলে মূলত তিনটি সম্প্রদায় - কৈবর্ত্য, পাটনী আর নমশূদ্র। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আলাদা আলাদা । খুব সুক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে ফারাকটা বোঝা যায়, কিন্ত চৌদ্দ মাদলের মেলায় এসে সব মিলেমিশে একাকার। আরেকটি বিষয় হল, সাধারণত বাঙালি মেয়েরা দূর্গোৎসবে বাপের বাড়ি আসে, এখানে কিন্ত ঠিক উল্টা। যাদের বিয়ে হয়েছে দূর দূর গ্রামে, তারা সবাই পূজার পরিবর্তে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন চৌদ্দ মাদল মেলার। পুরো মেলাটাতে মেয়েরাই বেশি, পুরুষদের দায়িত্ব শুধু নিরাপত্তা দেখা । সারা রাত জুড়ে চলে আনন্দ মেলা । সে এক আশ্চর্য অনুভূতি ।
বললাম, তোমার দৌলতে সেবার চৌদ্দ মাদল মেলা উপভোগ করেছিলাম, আজ দিলে আরও এক স্মরণীয় উপহার।
-- আপনার মনে আছে ?
-- বারে , থাকবে না ! আমি সাথে সাথেই উত্তর দিলাম।
-- টানা সাত রাত জেগে আপনার শরীর খারাপ করলো, আপনি তিন দিন বারতি থাকলেন -
-- মনে নেই আবার ? সেই সুবাদেই তো সেবার বাঘাইর সেবা দেখলাম।
বাঘাইর সেবা মনে পড়তেই মনে পড়ে গেল শর্মীর কথা । মুখ ফস্কে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, শর্মী এখন কোথায় থাকে গো ?
-- এখানেই থাকে দাদা । একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে ।
-- তাই ! আর ওর স্বামী, সন্তান ?
-- বিয়ে করেনি দাদা । একইভাবে আছেন, তবে একটা ছেলে দত্তক নিয়েছেন । সারাদিন কাটে স্কুল আর সমাজ সেবায় ।
আমার মনে পড়ে গেল ওর একটা এনজিও ছিল। নামটা আশা কিংবা স্বপ্ন বা ওই জাতীয় কিছু । আমিই নামটা দিয়েছিলাম। এই মূহুর্তে মনে পড়ছে না ।
বিশ্বজ্যোতি শুধরে দিলে , নামটা স্বপ্ন। বললে, আপনার দেওয়া নাম । তারপর খানিকটা থেমে জিজ্ঞেস করলে, যাবেন নাকি একবার ?
-- কে আমি ? চমকে উঠলাম। বললাম, নাঃ এবারে সম্ভব হচ্ছে না ।
-- গেলে কিন্ত দিদি খুব খুশি হতেন।
আমি নিরুত্তর। কি করে বলি, এই জীবনে আর সম্ভব নয় । কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াই ওর সম্মুখে । অথচ এই শর্মীর আকর্ষণেই সেবার আমি আরও কয়েকটি দিন শনবিলে কাটিয়েছিলাম। খুব যত্ন নিয়েছিল আমার । তখনই দেখেছিলাম শনবিলের আরও এক লোক ঐতিহ্য বাঘাইর সেবা। সে আমার সত্যি সৌভাগ্য। সারা মাঘ মাস জুড়ে প্রতিদিন একজনকে বাঘ সাজানো হয় । তারপর খোল বড় করতাল নিয়েণপেট্রোমাক্স হাতে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে চাঁদা সংগ্রহ করা হয় । সঙ্গে হয় বাঘাইর সেবার নির্দিষ্ট কিছু গান আর ঢোল করতালের তালে নাচ । সারা মাস জুড়ে চাঁদা সংগ্রহ করে মাঘ সংক্রান্তিতে হয় বাঘের পূজা । একটা বাঘের প্রতিকৃতি তৈরি করে গ্রামীণ নিজস্ব ঢঙে প্রথম পূজা হয় , থাকে খোল করতাল বাজিয়ে গান আর সবার জন্য খিচুড়ি প্রসাদ । একসময়ে এতদাঞ্চলে বাঘের উপদ্রব হয়তো অত্যধিক ছিল আর থেকে নিষ্কৃতি পেতেই এই প্রতীকী পূজা ।
তবে ধীরে ধীরে এইসব লোক ঐতিহ্য লুপ্ত হবার পথে । ধরে রাখার লোকের ভীষণ অভাব ।
কথায় কথায় আমরা ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি । মোড়ের একটা দোকান দেখিয়ে বিশ্বজ্যোতি জিজ্ঞেস করলে, চা খাবেন দাদা ? এখানে চা খুব ভাল বানায় ।
-- কোথায় ? সুবলের দোকান ? আমি অনেকবার খেয়েছি ।
-- যাবেন ?
বললাম, চলো, যাওয়া যেতেই পারে । আমাদের হাতে এখন নিশ্চয়ই সময় আছে, বলো ?
-- অনেকটা দাদা । ঠিক সাতটা গাড়িকে আসতে বলেছি ।
তাহলে আর কি, অঢেল সময় । আজ রাতে আমাদের একটা নিমন্ত্রণ আছে, পুতুলের বিয়ে ।আসলে এই বিয়ে এটেন্ড করতেই এখানে আসা ।পুতুল বলতে সত্যিকারের পুতুল। কারো নাম নয় । এই লুপ্তপ্রায় বিয়েতে নিমন্ত্রণ পেয়ে না এসে পারলাম না । নৌকা বিহারটি আসলে এক্সট্রা বোনাস ।
দোকানটা ছিমছাম, অনেকটাই আগের মত । টেবিলে টেবিলে যেমনটি গ্রামীণ আড্ডা হয় । আমাদের দেখে একদল টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। তখনও চা দেয়নি, একজন ভদ্রলোক কোণায় বসেছিলেন। সরাসরি উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন?
-- ভাল । আপনি ? আমি অবাক! এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাকে কেউ চিনতে পারে আমার কল্পনায়ও ছিল না । বিশ্বজ্যোতি নিজেও কম অবাক হয়নি । বললে, তুমি ওনাকে চেনো বিশুদা ?
-- কেন চিনবো না ? ইউনিভার্সিটিতে আমাদের কতবার দেখা হয়েছে । তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে আমাকে আবারও প্রশ্ন করলেন, কেমন দেখলেন ?
-- কি ? আমি বুঝতে পারিনি ।
-- কেন? শনবিল ?
আমি হেসে ধীরে ধীরে আবৃত্তি করলাম-
"-- দেখিলাম শনবিল সাগর সমান
চাহিলে তাহার পানে কেঁপে ওঠে প্রাণ ।
উত্তাল তরঙ্গ রাশি হেরিলে নয়নে
অসীম সাহসীজনে ভয় পায় মনে ।"
-- আরে ব্বাস ! আপনি পড়েছেন নবাব রাধারাম ? ভদ্রলোক রীতিমত উত্তেজিত ।
আমি প্রত্যুত্তরে ভদ্রলোককে নিরাশ করে বললাম, না সরি, আমার রমনীমোহন সরকারের নবাব রাধারাম পড়া হয়নি, তবে দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎ বঙ্গ আর অচ্যুতচরণ চৌধুরীর শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত আমি পড়েছি । আবার শনবিলের কথা লিখেছেন শ্যামলাল দাস । আমি ওইটেও পড়েছি । দেখেছি তিনটি বইএ একই বক্তব্য।
ইতিমধ্যেই আরও দুই একজন চেয়ার টেনে বসে গেছেন গল্প শোনার অছিলায় । চায়ের সংখ্যাটি বাড়িয়ে দিয়ে একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, সংক্ষেপে যদি বলতে হয় --
আমার কথাটা পুরোপুরি বলাই হয়নি, তার আগেই বিশাল প্রতিবাদ। আমাকে বিস্তৃত বলতে হবে । বললাম, নিজেই কতটুকু জানি তবু চেষ্টা করি । আসলে প্রতাপগড় একসময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে ছিল । কাজেই প্রতাপগড়ের ইতিহাস ওই রাজ্যের ইতিহাসে উল্লেখ আছে । ওই অংশটুকু থাক । আমাদের আজকের বিষয় হচ্ছেন রাধারাম। শ্রীহট্টের তালতলা নিবাসী রাজারাম দত্তের এক গোধা পুত্রের জন্ম হয়েছিল । নাম রাখা হয় রাধারাম । তাই নিয়ে রাজারামের মন ভীষণ খারাপ। একদিন তাদের বাড়িতে নীলকন্ঠ গিরি নামে এক সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে । রাধারাম মন প্রাণ দিয়ে সন্ন্যাসীর সেবা করলে সন্ন্যাসী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পায়ে মালিশ করার জন্য একটা প্রলেপ দেন । সেই আশ্চর্য প্রলেপের গুণে রাধারামের গোধা পা স্বাভাবিক হয়ে যায় । রাধারাম সন্ন্যাসীর সেই আশ্চর্য ক্ষমতায় অভিভূত হয়ে পড়েন । আর সেই থেকেই সন্ন্যাসীর পরম ভক্ত হয়ে গেলেন । সন্ন্যাসী যখন তাদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন, রাধারামও তখন তার সাথে গৃহত্যাগী হলেন । দুজনে চরগোলা হয়ে প্রথম রাত্রি এসে যাপন করলেন ফাকোয়া গ্রামের এক টিলায় । কথিত হয় সেই থেকে ওই টিলা সন্ন্যাসী পাট্টা নামে খ্যাত। আজও ফাকোয়া স্টেশনের দক্ষিণে সন্ন্যাসী পাট্টা বিদ্যমান।
এদিকে সন্ন্যাসী ছিলেন সাধক প্রকৃতির লোক । রাধারামের উপস্থিতি তার সাধনে ভীষণ অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। ওইসময়ে চরগোলা ঘন জঙ্গল। বিলের পূর্ব পাড়ে তখন সৈইজা বাদশা নামে এক পীর থাকতেন। সন্ন্যাসী তখন রাধারামকে পীরের কাছে সমজে দিয়ে নিজের সাধনস্থল ছাতাচূঁড়া পাহাড়ে চলে গেলেন । সৈইজা বাদশা রাধারামকে পুত্রজ্ঞানে স্নেহ করে জমি জায়গা দিয়ে শুধু বলে গেলেন, যদি কোন দিন কেউ বাদশার দোহাই দেয় তবে তা যেন কোন অবস্থাতেই অমান্য না করা হয় । রাধারাম তখন পীরের নির্দেশ অনুসারে প্রথমে বাবার অনুমতি নিয়ে এসে গামারিয়া অঞ্চলে চাষ শুরু করেন । দেবদ্বারে তখনি জনবসতি ছিল। রাধারাম ক্রমে সিঙ্গুয়া-ফুলতলি, ছড়ারপার, খালেরপার, সিঙ্গুয়া, দরগারবন্দ, ইত্যাদি স্থানে জনবসতি সৃষ্টি করেন । তথাপি আশানুরূপ উন্নতি না দেখতে পেয়ে সৈইজা বাদশার অনুমতি নিয়ে তিনি প্রতাপগড়ে চলে যান । ওখানে গোলাম আলীর বাড়ির সম্মুখে দোকান পরিচালনা শুরু করেন। তারপর গোলাম আলীর বাড়িতে দোকানের জিনিসপত্র ইত্যাদি পাঠিয়ে ধীরে ধীরে জমিদারির অধিকারী হন । সেই সঙ্গে দখলে আনেন চরগোলার বিস্তীর্ণ জঙ্গল এবং নিজে নবাব উপাধি ধারণ করেন। পাশাপাশি ত্রিপুরার মহারাজা দূর্গামানিক্যের কাছ থেকে চরগোলা তালুক বন্দোবস্ত নিয়ে সরকার উপাধির এক ব্যক্তিকে দপ্তর পরিচালনার দায়িত্ব দেন । আজও সেই বাড়ি সরকার বাড়ি নামে খ্যাত। এতদিনে রাধারামের প্রতাপ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । এবারে তিনি ইংরেজ শাসন অগ্রাহ্য করে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করেন। ততদিনে ত্রিপুরার মহারাজের নামের প্রভাব খাটিয়ে পার্বত্য কুকি সর্দারের সাথে মিত্রতা তৈরি হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সমস্ত কুকিরা রাধারামের বশে চলে আসে । বাড়ির পাশেই তৈরি হয় নিজস্ব বিচারালয়, জেলখানা এমনকি দূর্গ । রাধারামের ভগ্ন , জঙ্গলে ঢাকা দূর্গ আজও কেল্লাবাড়ি নামে পরিচিত। ধীরে ধীরে তিনি এখন শ্রীহট্টের পূর্ব দক্ষিণ প্রান্তে এক পরাক্রমী পুরুষ। এবারে ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয়ে যায় । প্রথমেই তার নজর যায় গোলাম আলীর ছেলে গোলাম রাজা চৌধুরীর উপর। তাকে বিনাশ করতে তিনি প্রতাপগড় আক্রমণ করেন। এতে বহুলোকের ক্ষয়ক্ষতি হয় । গোলাম রাজা, কানুরাম চৌধুরীর সহায়তায় কোনক্রমে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন । এবারে রাধারাম চরগোলার থানাদারকে আক্রমণ করে সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেন, সাল ১৭৮৬ ।
-- তারমানে সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে ? কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন।
বললাম, ঠিক তাই । আমরা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপান হিসাবে চিহ্নিত করি অথচ তারও একাত্তর বছর আগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ হয়েছে এই উপত্যকায়, অথচ ইতিহাসে সেই বিদ্রোহকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি । এ আমাদের দুর্ভাগ্য নয়তো কি ?
বুঝলাম এই প্রশ্ন শুধু আমার একার নয় এখানে উপস্থিত সবার। ভিতরে ভিতরে সবার মনেই একটা প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে ।
বললাম, এখানেই শেষ নয় । সেই সময় শ্রীহট্টের কালেকটার লিন্ডস সাহেব রাধারামকে দমন করতে শনবিলে দুই শতাধিক সৈন্য পাঠিয়েছিলেন । রাধারাম কুকি সৈন্যের সাহায্যে সেই সৈন্যদের মূহুর্তে পরাজিত করেন । প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের পর ইংরেজরা আরও অধিক সৈন্য নিয়ে শনবিলে আসে । উদ্দেশ্য রাধারামকে যেভাবেই হোক পরাজিত করা । সেবার রাধারামের ভাগ্য সহায়, শনবিল রুদ্রমূর্তি ধারণ করার ফলে অধিকাংশ নৌকা জলে ডুবে যায় । বিনা যুদ্ধে রাধারাম দ্বিতীয়বারও জয়ী হন । এতে রাধারামের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় । রাধারাম স্বৈরাচারী হয়ে যান । ধীরে ধীরে তার অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে । বঙ্গ দর্শন কিংবা শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে তার খানিকটা বিবরণের উল্লেখ পাওয়া যায় । ওইসময়েই একদিন তিনি কয়েকটি ব্যভিচার পরায়ণ পুরুষ মহিলাকে জোড়ায় জোড়ায় ধরে এনে গুলি করে হত্যা করেন । সর্বশেষ স্ত্রীলোকটি দৈবক্রমে বেঁচে গিয়ে সৈইজা বাদশার দোহাই দেয় কিন্ত রাধারাম রাগবশতঃ তা অমান্য করে স্ত্রীলোকটিকে তক্ষুণি হত্যা করেন। আর
মুহুর্তে সম্বিত ফিরতেই বুঝতে পারেন বিশাল ভুল হয়ে গেছে । এবারে তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া চাই। প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে স্থির হয় ১০৮ কালীপুজো হব এবং শেষে নরবলি দেওয়া হবে । এবারে আবার ভুল। বলি নির্বাচিত করেন কল্পিত শত্রু ,বন্ধু কানুরাম চৌধুরীকে । তার ধারণা কানুরাম ভিতরে ভিতরে গোলাম রাজাকে সাহায্য করছেন তাই তিনি গোলাম রাজাকে শেষ করতে পারছেন না । কানুরাম সরল বিশ্বাসে বন্ধুর নিমন্ত্রণে ভৃত্য বিজয়, সাথে আরও দুজন মুসলমান সর্দারকে সঙ্গে নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন । সৌভাগ্য বশত বিজয় কোন সূত্রে জানতে পারে আজ তার প্রভুকেই এখানে বলি দেওয়া হবে । কানুরাম তিনজনের সহায়তায় পালিয়ে গিয়ে কোনক্রমে প্রাণ বাঁচান ।
এর ফলে কানুরাম পরদিনই ইংরেজদের সব জানিয়ে ধোয়ালিয়া পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আক্রমণের পরামর্শ দেন । যুদ্ধে রাধারাম পরাজিত হয়ে পলায়ণ করেন । পরবর্তী কালে সিদ্ধেশ্বরে বারুণীতে ধরা পড়লে তাকে লোহার খাঁচায় বন্দি করে শ্রীহট্টের পাঠানো হয় । রাধারাম অবশেষে আত্মহত্যা করে বৃটিশের দন্ড থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে ।
এই পর্যন্ত বলে একটু থেমে বললাম, এযাবৎ যা বলেছি তার সবটাই শ্যামলাল দাসের বইএ আছে । কিন্ত দীনেশ চন্দ্র সেনের বঙ্গ দর্শন যদি অনুধাবন করি তবে নবাব রাধারামকে প্রথমে সম্ভবত ছাপা বিভ্রাটে রাধারমণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল । পরবর্তী পেরায় সংশোধিত নামের সাথে কানুরামের বৃত্তান্তে আবারও সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় । তবে এখানে কানুরামের ইংরেজ সহযোগিতা এবং পরবর্তীকালে সিদ্ধেশ্বরের বারুণীতে বন্দি হওয়ার কোনও উল্লেখ নেই । তার মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা বলা হয়েছে এবং অধিকন্তু তার পুত্র জয়মঙ্গলের ডোমের ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা ও বন্দি হওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় । এখানে গ্রন্থকার তার বক্তব্যের স্বপক্ষে একটি প্রচলিত গানেরও উল্লেখ করেছেন যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখনও কৃষকেরা লাঙ্গল চালাতে চালাতে গানটি গেয়ে থাকে - " কান্দেরে চরগোলার লোক দেশে দেশান্তর । জয়মঙ্গল আসিবে যবে চরগোলার নগর । ডোম চাঁড়াল মিলিয়ারে বানাইয়া দিমু ঘর ।" অচ্যুতচরণ চৌধুরীর শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত শ্যামলাল দাসের বক্তব্য প্রায় এক ।
আমি থামতেই বিশ্বজ্যোতি সুযোগ নিয়ে সময়টা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললে, দাদা, গাড়ি কিন্ত এসে গেছে ।
আসলেই আসরটা খুব জমে উঠেছিল। আমার নিজেরও একটা দোষ আছে, গল্পে মাতলে সময়ের খেয়াল থাকে না । বললাম, এতটাই যখন এখানে আলোচনা হল, আমার ব্যক্তিগত দুই একটা ইচ্ছের কথা না বলে শেষ করি কি করে ?
আমি এই কথাগুলো বহুবার বহু জায়গাতেই বলেছি, লাভ হয়নি । আজও হবে সে আশা করি না । তবু বললাম, আপনারা জানেন ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহী সিপাহীরা লাতু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেবদ্বার পুঁটিঘাট দিয়ে সিরিসপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সিপাহী বিদ্রোহের স্থান থাকলেও এই অঞ্চলের সংগ্রামের কোন উল্লেখ নেই । আমরা যদি ভৈরবনগরের সেই জঙ্গীর গোল-এ রাত্রি যাপনের স্থানটিতে কিংবা বিদ্রোহীদের শনবিলে প্রথমপা রাখার স্থানটি সিপাহীটিলায় কিছু একটা নিদেনপক্ষে একটি স্মৃতি স্মারক তৈরি না করি আগামীদিনে এইসব জায়গা চিনে নিতেই খুব অসুবিধা হবে ।
দেখলাম স্থানীয় লোকও এবিষয়ে ভীষণ সচেতন। সবার হয়ে বিশ্বজ্যোতিই বললে, দাদা আমরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছি । শুধু জঙ্গীর গোল নয়, সিপাহী টিলা, মিশন টিলা, রণটিলা সহ আরও কিছু জায়গাও আমাদের পরিকল্পনায় আছে ।
গল্পে গল্পে অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে । আমাদের একটা নিমন্ত্রণ ছিল পুতুলের বিয়েতে । সবার কাছে একে একে বিদায় নিয়ে দেবদ্বারে অনন্ত দাসের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। একসময়ে এই দেবদ্বারে বৈশাখ মাস জুড়ে বাড়ি বাড়ি পুতুল বিয়ের আয়োজন করা হত । কোন কোন বাড়িতে বর-বধুর দুটো পুতুল আবার কোথাও শুধু কনে তৈরি করে অন্য বাড়ির বর এনে বিয়ের ব্যবস্থা করা হত। আজকাল দুই একটা বাড়ি ছাড়া সর্বত্র বন্ধ হয়ে গেছে । পুতুলগুলো কাপড়ের তৈরি । ছোটবেলায় আমরা যে পুতুল পুতুল খেলতাম এটাই এখানে সারম্ভরে অনুষ্ঠিত হয় । আমাদের আসার খবর পেয়ে গৃহকর্তা নিজে গেটে এসে আমাদের আমন্ত্রণ করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বিশাল ব্যবস্থা । একপাশে কুঞ্জ বানানো হয়েছে, খানিক বাদেই ওখানে বিয়ে হবে । অন্যপাশে গ্রামের মহিলারা বিয়ের গীত গেয়ে ধামাইল দিচ্ছেন। জমজমাট পরিবেশ । অনেকেরই সাথে পরিচয় হল এখানে । একজন ভদ্রলোক আমাকে হোরী গানের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেন। হোরী গান বা হুরী গান মূলত বসন্ত কালের উৎসব । দোলযাত্রার সময়ে অনুষ্ঠিত হয় । এই উৎসবে এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামের মানুষদের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায় । এক বিশাল জায়গাতে শ'য়ে শ'য়ে লোক জড়ো হন । এক একটা দলে কম করেও ত্রিশ পয়ত্রিশ জন শিল্পী থাকেন। তারমধ্যে পাঁচ ছয়জন খুব দক্ষ শিল্পীর প্রয়োজন । বড় বড় করতাল ঢোল ইত্যাদি নিয়ে গানের লড়াই হয় । গানের তাল, নাচ সবকিছুই একটু ব্যতিক্রমী । লড়াই বলে কথা । আমার কোনদিনই দেখার সৌভাগ্য হয়নি । সবটাই ভদ্রলোকের কাছ থেকে শোনা । বিশ্বজ্যোতিকে একটা বিশেষ কাজে চলে যেতে হয়েছে । পুতুলের বিয়ে নিয়ে আমার কিছু কৌতুহল ছিল । বাড়ির গৃহকর্তী এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে সময় দিলেন । যতটুকু বুঝলাম এখানে ধর্মীয় কোন আচরণবিধি নেই, সবটাই লৌকিক। একদিনের অনুষ্ঠান, নিজস্ব গীত আছে এবং সেই গীতেরও একটা ক্রম তালিকা আছে । লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে সারা মাস ব্যাপী বাড়ি বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বৈশাখ সংক্রান্তিতে কলাগাছে চৌচালা ভেলা বানিয়ে চিড়া, গুড়, বাড়িতে তৈরি পিঠা, পুলি ইত্যাদি সহ পুতুল জোড়াকে সাজিয়ে শনবিল ভাসিয়ে দেওয়া হয় ।সঙ্গে অবশ্যই থাকে মহিলাদের গীত । এখানেই গল্পের মোচড়, কোথাও যেন বেহুলা লক্ষীন্দরের ছায়া । আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভদ্রমহিলা সরল মনেই উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, উনার সঠিক জানা নেই । তাছাড়া এই নিয়ে যদি গবেষণা হতো, হয়তো সত্যি বেরিয়ে আসতো । কিন্ত সেই সম্ভাবনাও আপাতত নেই। একটা গানের কলি শুনিয়ে ছিলেন-
যাইও না মাই ভিতর গাঙে
যাইও গো বাঘল মাই
টেকার লাইগ্যে দূরই দিলাম বিয়া ।
চিড়া ঝিঙ্গা রইয়া আইলাম
মানছইন না কইয়া আইলাম
আমার মাইয়ে কান্দিলে
বুঝাইও গো বাঘল মাই
টেকার লাইগ্যে দূরই দিলাম বিয়া ।
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা । সবাই বর কনে নিয়ে বিয়েতে ব্যস্ত। আমার এক প্রস্থ মিষ্টি খাওয়া শেষ । একজন ভদ্রলোককে বললাম আমার চলে যাওয়ার সংবাদটি পৌঁছে দিতে ।
সবে গেটে পা রেখেছি, পিছন থেকে এক মহিলা কন্ঠস্বর, কোথায় যাচ্ছেন ?
পিছন ফিরে তাকিয়ে আমার চমকে উঠার পালা । বললাম, তুমি ? এখানে ?
-- কেন থাকতে নেই বুঝি ?
-- না মানে তুমি এখানে - মানে তোমার সাথে আমার এখানেই দেখা হয়ে যাবে , আমার ধারণা ছিল না।
-- কি করি ? তোমাকে খবর দিলে যে তুমি আসো না, তাই ইচ্ছে করেই এখানে এলাম ।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, কেমন আছ?
-- তোমার কেমন মনে হয় ?
এই প্রশ্নের উত্তর হয় না । বললাম, আমি এখন যাচ্ছি, বাড়ির কর্তাকে খবরটা পৌঁছে দিও ।
শর্মী ম্লান হেসে বলল, যাচ্ছি নয়, পালাচ্ছো বল ?
-- না না পালাবো কেন ? কাল সকালে আমাকে ফিরতে হবে, তাই । আমি আমতা আমতা উত্তর দিলাম।
-- খাওয়া হয়েছে ?
-- হ্যাঁ ।
-- মিথ্যে কথা । চল ।
-- প্লিজ, আমাকে আর খেতে অনুরোধ করো না, আমাকে এবার যেতে হবে ।
--আর একটাও কথা না । তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে সোজা খাবার জায়গাতে বসিয়ে দিল । খেতে ইচ্ছে করছিল না, তবু খেতে হল । নিজে বসে একটা একটা করে খাওয়ানো । কারো মুখেই কোন কথা নেই। একসময়ে শর্মী নিজেই নীরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করলো, কাল তুমি কখন রওয়ানা দিচ্ছ ?
বললাম, চেষ্টা করছি সকাল নয়টায় বেরিয়ে যেতে ।
-- যাবার আগে তোমাকে একটা অনুষ্ঠান এটেন্ড করতেই হবে ।
বললাম, অসম্ভব।
-- আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি আশাকরি তুমি আমার সম্মানটা বজায় রাখবে।
-- কিন্ত আমার যে -- ।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে চারিদিক ভাল করে লক্ষ্য করে ফিসফিস করে বললে, তোমার ছেলেকে একবার দেখবে না ?
-- আমার ছেলে ?
-- আস্তে চিৎকার করো না -
-- কোথায় ? আমি কিছুই জানি না তো !
শর্মী অনেকটা সময় চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থেকে হাতে জল ঢেলে দিতে দিতে বললে, এখন বাড়ি যাও , কাল সকালে কথা হবে ।
সারা রাত দুটো পাতা এক করতে পারিনি । শর্মী যখন বারবার বিয়ের প্রেসার দিচ্ছিল তখন আমি বেকার। নিজের খাবারের সংস্থান নেই অন্যের দায়িত্ব নেই কি করে । অনেক বুঝিয়েছি, কিন্ত বুঝতে চাইছিল না ।একটা সময়ে ওর সাথে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলাম, তারপর একদিন সে নিজেই যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিল । ভুল যে হয়নি তা নয়, কিন্ত বিপদের কোন ইঙ্গিত সে আমাকে কোনদিনই দেয়নি । তাহলে ছেলে আসছে কোথা থেকে !
সারারাত ঘুম নেই চোখে । সকাল হতেই তৈরি হয়ে বসা । হঠাৎই একটা উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে এসে হাজির। একটা চিঠি হাতে দিয়ে বললে, চলুন।
বন্ধ খামের ভিতর ছোট্ট এক চিরকুট -। আমি ধীরে ধীরে খুলে পড়তে শুরু করলাম -
প্রিয়তমেষু,
এই আমাদের ছেলে । ভাল করে লক্ষ্য করে দেখো, তোমাকে খুঁজে পাও কিনা । পিতৃপরিচয় আমি দাবি করি না, যদি পরো .... , না থাক, ওর সাথে চলে এসো ।তোমার খুব বেশি সময় আমরা নেব না ।
ভাল থেকো ।
ইতি -
চিঠিটা একবার, দুবার, তিনবার পড়লাম, তবু পাথরের মত বসে আছি । পায়ের তলা থেকে কে যেন মাটি সরিয়ে নিয়ে গেছে । বুকের ভেতর একটা প্রচন্ড ব্যাথা, দুই চোখ বয়ে অজান্তেই জলের ধারা ।
ছেলেটা কিংকর্তব্য বিমূঢ়। বুঝতে পারছে না কি ঘটে চলছে । আস্তে করে বললে, মা বলেছিল, আপনাকে প্রণাম করতে, আমি কি আপনাকে প্রণাম করতে পারি ?
-- অবশ্যই করতে পারো । কাছে এসো ।
হাত দুটো ধরে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি ?
-- স্বপ্নাশীষ ।
-- আমার নাম কি জানো ?
-- জানি । তারপর একটু থেমে বললে, আশীষ সেন ।
-- তোমার আর আমার নামে একটা মিল আছে , তুমি কি জানো ?
-- জানি ।
-- আমাকে তোমার মা কি ডাকতে বলেছেন ?
-- কাকু ।
বললাম, না । তুমি আমার সন্তানের মত । তুমি আমাকে বাবা ডাকবে এখন থেকে । কথাটা শেষ করার আগেই দুহাতে ছেলে বুকে ঝাপটে নিয়ে সমস্ত উষ্ণতা শুষে নিতে লাগলাম।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি জানিনা । একসময়ে ছেলেটা ফিসফিস করে বললে, তুমি এখন যাবে না বাবা ?
Comments
Post a Comment